“অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে,

কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে” – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শুধু অতিকায় হস্তীই (ম্যামথ) নয়; বাইসন, ডাইনাসোরের মত অতিকায় প্রাণী থেকে শুরু করে বুলডগ র‍্যাট, অতিক্ষুদ্র জীব-পরজীবী সব জীবই কম বেশি লোপ পেয়েছে। কিন্তু এই ছোট্ট কাল তেলতেলে কুচকুচে তেলাপোকা ৩৫০ মিলিয়ন বছর ধরে সগৌরবে(!)টিকে আছে; ঠিক আগের মতনই। অথচ ডাইনাসোর’রা ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে এসে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে; আর আমরা মানুষরা পৃথিবীতে আছি মাত্র ২ মিলিয়ন বছর আগে; কত ছোট আমরা।

প্রকৃতিতে সকল প্রাণীরই প্রধান লক্ষ টিকে থাকা (survive) (এমনকি মানুষেরও প্রাথমিক সময়কালে একমাত্র লক্ষ ছিল তাই, এখন শুধু টিকে থাকলেই চলে না, দেখানো লাগে কিছু); এবং এই টিকে থাকার দৌড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়ী তেলাপোকা। পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তারা এখন যেকোন প্রতিকুল পরিবেশেই মানিয়ে নিতে পারে। এমনকি নিউক্লিয়ার বোমাও তাদের খুব একটা কিছু করতে পারে না (নাগাসাকি তে পারমানবিক হামলার পরও সেখানে তেলাপোকা বেঁচে ছিল)। তাহলে দেখা যাক,যুগের পর যুগ অভিযোজনের ফলে তেলাপোকা কীরকম অবস্থায় এসে দাড়িয়েছে, আর তাদের অস্বাভাবিক ক্ষমতা কী কী?    

                                                                                    bigstockCockroach3642346

তেলাপোকার জীবনী শক্তি দিয়েই শুরু করা যাক; অন্য যে কোন প্রাণীর চেয়ে এদের জীবনী শক্তি অস্বাভাবিক রকমের বেশি। তেলাপোকা কোন খাবার ছাড়াই ৪০ দিন বাঁচতে পারে, পানি ছাড়া পারে ১০ দিন, অক্সিজেন ছাড়া পারে ৪০ মিনিট। এমনকি মাথা-কাটা অবস্থায় (মাথা একজায়গায় শরীর আরেক জায়গায়) এরা ৭ দিন বাঁচতে পারে ( কাঁটা মাথা টিকে থাকে প্রায় ১ দিন) এবং চলাচলও করতে পারে। এছাড়া তেলাপোকার দেহের কিছু বিশেষ চলন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে অথবা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তা পুনরায় তৈরি হয়!

কী খায় তেলাপোকা? না, বরং প্রশ্ন করা উচিত কী খায় না? গবেষণায় দেখা গেছে, সিমেন্ট ও সিমেন্টজাত পণ্য ছাড়া সব কিছুই তেলাপোকা খায়। এমনকি মানুষের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও বাদ দেয় না; মানবদেহের মধ্যে এদের প্রিয় খাবার হাত পায়ের তালু, আঙ্গুলের অগ্র-ভাগ, ঠোঁট।

আচ্ছা, তেলাপোকা কি উড়তে পারে? বোকাবোকা প্রশ্ন মনে হলেও সত্য ঘটনা হল তেলাপোকা উড়তে পারে না। তাহলে আমরা যে উড়তে দেখি? আসলে সেটা আসলে উড়া নয়, অনেকটা গ্লাইডিং  বলা যেতে পারে ( উডুক্কু কাঠবিড়ালি যেমন এক গাছ থেকে আরেক গাছে গ্লাইড করে); এবং এই গ্লাইডিং কে বলে Nuptial Flight। এই Nuptial Flight সর্বোচ্চ ৯ মিটার অবধি হতে পারে।

আর এদের গতিও অস্বাভাবিক দ্রুত; ঘণ্টায় ২০০ মাইল! তারা বিপদ বুঝতে পারে ৪০ মিলি সেকেন্ডের মধ্যে এবং বিপদে পড়লে এদের সর্বোচ্চ গতিবেগ ৩১ ইঞ্চি/সেকেন্ড রেকর্ড করা হয়েছে। এর মূলে রয়েছে ১৮ টি শক্তিশালী হাঁটু।

তেলাপোকার বংশবিস্তারের ক্ষেত্রেও বিস্ময়কর প্রতিভা দেখা যায়। তেলাপোকা তার জীবদ্দশায় বছরে প্রায় আটবার ডিম দেয়  এবং প্রতিবারে  ৪০ টি করে ডিম দেয়। এবং সেই ডিম পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তা শরীরে নিয়ে চলাচল করে মা তেলাপোকা, ডিম সংরক্ষণ করে  উথেকা নামক এক বিশেষ থলিতে। এই থলি আমরা সবাইই দেখেছি, দেয়ালে লেগে থাকতে কিংবা ঘরের কোন চিপায় ছোট খয়েরী রঙের চিপ এর মত। কিছু কিছু তেলাপোকা প্রজাতির (যেমন জার্মান তেলাপোকা) এতই প্রতিভা যে, তারা একবার গর্ভবতী হলে সারাজীবন গর্ভবতী থেকে যায় এবং ডিম দিয়ে যায় 😯 ।

তেলাপোকা বায়ুমণ্ডলের তারতম্য বুঝতে পারে; বুঝতে পারে বড় কোন দুর্যোগের পূর্বাভাস।

তেলাপোকার আকারের ক্ষেত্রে বেশ তারতম্য দেখা যায়, যেমন আমাদের প্রতিবেশী তেলাপোকা গোষ্ঠী অনেক ছোট হলেও এখনও অনেক প্রজাতির তেলাপোকা পাওয়া যায় বিশেষ করে বন-জঙ্গলে যারা ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা হয় ( আমার দেখা সবচেয়ে বড়টা দেখেছি সিলেট শহরের ফুটপাতে, একটা না বেশ কয়েকটা, আকারে ৩.৫-৪ ইঞ্চি হবে; কিন্তু কিছু করে না, শুধু শুয়ে থাকে )। তবে ডাইনাসোরের যুগের মত ৩০ ইঞ্চি তেলাপোকা এখন আর নেই।

পৃথিবীতে প্রায় ৪ হাজার তেলাপোকা আছে, তবে এর মধ্যে আমাদের লোকালয়ে থাকে ৩০ প্রজাতির। এই ৩০ প্রজাতির মধ্যে আমাদের দেশে পাওয়া যায়, Periplaneta Americana, Blattella germanica, Blatta orientalis । এদের মধ্যে আমাদের স্থানীয় তেলাপোকা হচ্ছে Blatta orientalis। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈনিকরা  Periplaneta Americana এবং জার্মান সৈনিকরা Blattella germanica সাথে করে নিয়ে এসেছে।

রোগ জীবানু ছড়ানোর দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই এরা। প্রায় ৪০ রকমের ব্যাকটেরিয়া বহন করে এরা, যেগুলো থেকে এরা ভিটামিন খায় আর আমাদের মাঝে রোগ ছড়ায়।

তেলাপোকা নিয়ে মানুষের পাগলামিরও শেষ নেই। চলে গিনেজ বুকে নাম লিখানোর প্রতিযোগিতা। রেকর্ড বুক অনুযায়ী নিউইয়র্ক এর একটা বাড়ি থেকে ১ মিলিয়ন তেলাপোকা উদ্ধার করা হয়েছে, এটাই সম্ভবত সর্বোচ্চ। এছাড়া একটা বিয়ারের কার্টুন থেকে ৬০০০ তেলাপোকার রেকর্ডও খারাপ না। তবে জাপানের এক ব্যাক্তি দাবি করেন তার বাড়িতে তার সাথে দেড় লাখ তেলাপোকা থাকে। এ ব্যাপারে মীমাংসা হয় নি এখনও; দেড় লাখ গোণা কি সোজা কথা?

তেলাপোকা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক সিনেমা, কার্টুন , বই। তার মধ্যে ‘Oggy and The Cockroaches’ কার্টুন সিরিজ বেশ বিখ্যাত। ধারণা করা হয় ‘টম এন্ড জেরী’র পর এটিই সবচেয়ে বিখ্যাত কার্টুন সিরিজ। এর নিয়মিত একজন দর্শক হিসেবে আমি সাজেস্ট করব- Oggy and The Cockroaches – The Movie – খুব ভাল একটা সিনেমা, শিক্ষণীয় ও সামাজিক ছবি; দেখতে পারেন। এই ছবির সবচেয়ে মজার বিষয় হল সিনেমা যেখান থেকে শুরু হয় ঠিক সেখানেই আবার শেষ হয়; কিন্তু না শেষ হয় না, আবার শুরু হয় 🙄 ।

                                                                latest

তেলাপোকা ভয় পায় না এমন মানুষ খুব কম আছে, কারো কারো ফোবিয়াও আছে।  একটা গবেষণায় দেখা যায়, মেয়েদের ৮৩% এবং ছেলেদের ৪৭% তেলাপোকা ভয় পায় (আমি এই ৪৭% এর অন্তর্ভুক্ত)। এবং প্রায় ৮৮% মানুষ জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে তেলাপোকা ভয় পেয়েছে।

এখানে ভয় পাওয়ার কি আছে? তেলাপোকাও তো ……

কৃতজ্ঞতাঃ

মিজানুর রহমান ভুঁইয়া

আহসান হাবীব

এবং গুগল