শব্দ কোন ধরনের তরঙ্গ? অনুপ্রস্থ নাকি অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ? যদি বলি দুটোই! আসলে শব্দ কোন ধরনের তরঙ্গ হিসেবে বিস্তৃত হবে তা নির্ভর করে মাধ্যমের উপর; শব্দ বায়বীয় মাধ্যমে শুধু অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গাকারে চললেও কঠিন ও বায়বীয় মাধ্যমে শব্দ অনুপ্রস্থ ও অনুদৈর্ঘ্য দুভাবেই চলতে পারে। কেন এরকম হয়?
অনুপ্রস্থ তরঙ্গের ক্ষেত্রে মাধ্যমের কণাগুলো একবার উপরে আরেকবার নিচে স্পন্দিত হয়; ফলে কণার অবস্থান পরিবর্তিত না হয়েই তরঙ্গ সামনে আগায়। কণা যখন সাম্যাবস্থা থেকে উপরে/নিচে যায় সে আবার কিসের টানে সাম্যাবস্থায় ফিরে আসে, সাম্যাবস্থায় আসার দরকারই বা কি? আসলে পদার্থের স্থিতিস্থাপক গুণের কারণেই কণা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। স্তিতিস্থাপকতা হল বস্তুকে সাম্যবস্থা হতে বিচ্যুত করলে আবার সাম্যাবস্থায় ফিরে আসার প্রবণতা। স্থিতিস্থাপক গুণ কিসের থাকে? মুলত সকল কঠিন পদার্থেরই এই গুণ রয়েছে। এজন্য কঠিনে খুব সহজেই অনুপ্রস্থ তরঙ্গ যেতে পারে। আচ্ছা, পানির তো কঠিনের মত স্থিতিস্থাপক গুণ নেই, তাহলে পানির ক্ষেত্রে কি অনুপ্রস্থ সম্ভব নয়? আসলে পানির স্থিতিস্থাপক গুণ না থাকলেও পানির প্রায় একইরকম আরেকটা গুণ আছে; তাহল পৃষ্ঠটান। এই পৃষ্ঠটান পানির ক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপকতার কাজ করে, ফলে পানিতেও অনুপ্রস্থ তরঙ্গ সম্ভব। কিন্তু গ্যাসের স্থিতিস্থাপক গুণ না থাকায় গ্যাস মাধ্যমে কখনই অনুপ্রস্থ তরঙ্গ সম্ভব নয়।
তাহলে কি গ্যাসে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ সম্ভব? হ্যা, অবশ্যই। অনুদৈর্ঘ্য হওয়ার জন্য তো স্থিতিস্থাপক গুণের প্রয়োজন নেই। তাহলে কি দরকার? দরকার শুধু কাঁপাকাঁপি। একটু কাঁপাকাঁপি করার সুযোগ দিলেই যেকোন তরঙ্গই সঙ্কোচন ও প্রসারনের মাধ্যমে (অনুদৈর্ঘ্য) সামনে এগিয়ে যাবে। এই সুযোগ কে বেশি দিতে পারবে বলতো? অবশ্যই গ্যাস; কারণ গ্যাসের নিজেরই তো অনেক জায়গা (আন্তঃআণবিক দূরুত্ব বেশি) আর তাদের নিজেদের মধ্যে তো খুব একটা টান থাকে না (আন্তঃআণবিক আকর্ষণ কম) , তাই সহজেই যে কোন তরঙ্গ পেলেই এরা কাঁপাকাঁপি লাগিয়ে দেয় এবং কাঁপতে কাঁপতে তরঙ্গকে মাথায় করে পার করে দিয়ে আসে। আচ্ছা তাহলে তরল এবং কঠিন কি একাজ করে না? হ্যা, করে; কঠিন ও তরল ও কাঁপাকাঁপি (সংকোচন-প্রসারণ) করার মাধ্যমে তরঙ্গ সঞ্চালিত করে। কিন্তু গ্যাসের মত এত বেশি করে না। কারণ তাদের নিজেদের মধ্যে টান থাকে অনেক বেশি এবং বেশি কাঁপাকাঁপি করার মত সুযোগও তাদের খুব একটা থাকে না।
তাহলে শব্দের ক্ষেত্রে কী ঘটবে? শব্দ যখন গ্যাস মাধ্যমে চলবে তখন সহজেই অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (সংকোচন-প্রসারণ) এর মাধ্যমে অগ্রসর হবে; এছাড়া তার আর উপায়ও তো নেই, গ্যাসে তো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ সম্ভবও নয়। আর যখন একই শব্দ তরল কিংবা কঠিনে চলবে তখন তার সামনে দুটো পথই খোলা (অনুপ্রস্থ ও অনুদৈর্ঘ্য), কিন্তু সে অনুপ্রস্থই বেছে নিবে। অনুদৈর্ঘ্য আকারে আগানোর চেয়ে অনুপ্রস্থ আকারে আগানো সহজ, যেহেতু এভাবে আগাতে বেশি কাঁপাকাঁপি করা লাগে না (তরল ও কঠিন কাঁপাকাঁপি করার সুযোগও দেয় না খুব একটা)।
তবে ক্ষেত্র বিশেষে শব্দ তরলে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গাকারে চলতে পারে, কখন এমনটা ঘটবে বলতো? যখন তরলের পৃষ্ঠটান কম হবে, তখন তো আর খুব একটা উপরে-নিচে করার উপায় থাকবে না। ফলে সংকোচন-প্রসারণ (অনুদৈর্ঘ্য) এর মাধ্যমেই আগাতে হবে।
এবার অন্য একটা প্রসঙ্গে আসা যাক, আচ্ছা, একটা ব্যাপার কি তাহলে আন্দাজ করতে পারি? যে, কেন মাধ্যম ভেদে শব্দের বেগ ভিন্ন হয়? ঠিক উপরের কারণগুলোর কারণেই এমনটা হয় ( আরও কারণ আছে যদিও)।
অনুদৈর্ঘ্যের চেয়ে অনুপ্রস্থ আকারে যাওয়ার সময়ে তরঙ্গের কম সময় লাগে। কারণ সংকোচন-প্রসারণে যে সময় লাগে তার চেয়ে কণার উপর নিচে যেতে (অনুপ্রস্থ) অনেক কম সময় লাগে, কারণ এখানে স্থিতিস্থাপকতার কারণে সরল ছন্দিত স্পন্দনে কণা স্পন্দিত হয় (সরল ছন্দিত স্পন্দনের মাধ্যমে পৃথিবীর অপর প্রান্তে যেতে লাগে ৪২ মিনিট)। একারণেই গ্যাস মাধ্যমে শব্দের বেগ কম আর কঠিন ও তরলে অনেক বেশি হয়। তাহলে আর একটা প্রশ্ন রয়েই যায় যে, অনুপ্রস্থ তো তরল ও কঠিন দু-জায়গাতেই হয়, তাহলে কঠিনে শব্দের বেগ এত বেশি আর তরলে তুলনামূলক কম হয় কেন? এমনটা হওয়ার কারণ, দু-জায়গাতে অনুপ্রস্থ তরঙ্গাকারে গেলেও দু-জায়গাতে কিন্তু একইরকম ভাবে কণা স্পন্দিত হয় না। কঠিনে স্থিতিস্থাপকতার কারণে আর তরলে পৃষ্ঠটানের কারণে কণা স্পন্দিত হয়। আর আমরা তো জানিই পৃষ্ঠটানের চেয়ে স্থিতিস্থাপকতার শক্তি কত বেশি। তাই স্পন্দিত হওয়ার সময়ও কম বেশি হয়; এবং বেগেরও তারতম্য হয়।
এবার একটা মৌলিক প্রশ্নে আসি, তরঙ্গ কি শুধু অনুপ্রস্থ আর অনুদৈর্ঘ্য এ দুরকমই? না, তরঙ্গ আরো অনেক ভাবে যেতে পারে। তবে আমাদের শব্দের তরঙ্গ আমাদের শ্রবণসীমার মধ্যে মূলত এ দুভাবেই যায়। আল্ট্রা-সনিক ও ইনফ্রাসনিক শব্দের ক্ষেত্রে শুধু কঠিন পদার্থে শব্দ আরও কয়েকটি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা দেয়া হল:
Wave Types in Solids | Particle Vibrations |
Longitudinal (অনুদৈর্ঘ্য) | Perpendicular to wave direction |
Transverse (অনুপ্রস্থ) | Perpendicular to wave direction |
Surface – Rayleigh | Elliptical orbit – symmetrical mode |
Plate Wave – Lamb | Component perpendicular to surface (extensional wave) |
Plate Wave – Love | Parallel to plane layer, perpendicular to wave direction |
Stoneley (Leaky Rayleigh Waves) | Wave guided along interface |
Sezawa | Antisymmetric mode |
এদের মধ্যে Surface-Rayleigh Wave মূলত অনুপ্রস্থ ও অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের মিলিত ফসল। এবং এই বিশেষ তরঙ্গ কঠিনের পৃষ্ঠের ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল। এরা পৃষ্ঠের বক্রতা অনুসরণ করে অগ্রসর হয়। ফলে এর মাধ্যমে তলের ক্ষেত্রফল সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা যায়।
আর এইসব Lamb, Love Wave নিয়ে কি আর বলব (কিছু জানলে তো বলব 😛 )। তবে Sezawa Wave কিন্তু খুব চমৎকার (কেন চমৎকার জানলেও বলব না 😛 )। এগুলো তরঙ্গ নিয়ে যখন গবেষণা করবে তখন জানতে পারবে।
শব্দ তরঙ্গ নিয়ে আজ এটুকুই । তবে এখানেই শেষ নয়; আবার আসব শব্দের চমক নিয়ে।
কৃতজ্ঞতা:
- গিয়াসউদ্দিন
- খালদে মোশাররফ মুকুট