ছোটবেলায় প্রথম যখন জানতে পারি যে, আমেরিকা বাংলাদেশের একদম বরাবর নিচে অবস্থিত; তখন প্রথমেই মনে হয়েছিল, আরে! তাহলে তো বাংলাদেশের যে কোন এক জায়গায় সুড়ঙ্গ কাটতে কাটতে একেবারে সোজা আমেরিকা চলে যাওয়া যাবে। শৈশব হিসেবে ব্যাপারটা এতটাই চমকপ্রদ ছিল যে, উত্তেজনায় ও শঙ্কায় কাউকে বলতে পর্যন্ত পারি নি, যদি সে আমার বুদ্ধি দিয়ে আমার আগেই আমেরিকা চলে যায়? পরে বুঝেছিলাম এরকম সুড়ঙ্গ কেটে অন্য প্রান্তে যাওয়ার চিন্তা কম বেশি সবাইই করে; যেমনটা করেছিলেন জুল ভার্ন  আরো ২০০ শত বছর আগেই। জুল ভার্ন কিন্তু শুধু কল্পনাই করেছেন, যেতে পারেন নি; এবং আজ পর্যন্ত কেউই পারেন নি। হতাশ হওয়ার কিছুই নেই, কেউ পারেনি বলে আমরাও পারবনা এমন তো নয়। আমরা হাল ছাড়ব না কখনই। তাহলে চলুন, চেষ্টা করে দেখা যাক কীভাবে কম সময়ে বিনা ক্লেশে শর্টকাটে ঘুরে আসা যায় আমেরিকায় (জার্নি থ্রু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ)।

প্রথমেই সুড়ঙ্গ খনন, ভিতরের চাপ, তাপমাত্রা, বাতাসের বাধা ইত্যাদি আনুসাঙ্গিক ছোট-ছোট(!) 😯  বাধা আমরা আলোচনার বাইরে রাখি; পরে এসব বিবেচনা করা হবে। মনে করি সুড়ঙ্গ আগে থেকেই প্রস্তুত, একদম আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত; শুধু লাফ দেয়ার অপেক্ষা। কিন্তু লাফ দেয়ার আগে, আমাদের আমেরিকাবাসী চ্যাট-বন্ধুকে জানানো দরকার না? আমরা কখন এসে পৌঁছাব? কখন রিসিভ করতে আসবে সে? তাহলে আগে বের করে নেই আমাদের আমেরিকা যেতে কত সময় লাগবে, এবং একই সাথে আমরা কি বেগে, কোন বলের সাহায্যে যাচ্ছি তাও দেখা যাক,

এখানে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলই আমাদের অপর প্রান্তে যেতে সাহায্য করবে। এই অভিকর্ষ বলের মান কীভাবে বের করা যায়? হ্যা, F=mg (যেখানে m আমাদের ভর) দিয়েই তো বের করা যায়; তবে এখানে g (অভিকর্ষজ ত্বরণ) কিন্তু ধ্রুব (9.8) থাকবে না । কারণ g তো দূরুত্বের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। তাহলে কি আমাদের জানা g= GM/Rদিয়ে বের করব? না তাও ভুল হচ্ছে। এ সূত্র পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে বাইরের দিকের জন্য প্রযোজ্য, ভেতরের জন্য নয়। কারণ, আমরা যখন পৃথিবীর অভ্যন্তরের দিকে যাব তখন কিন্তু আমাদের উপর পুরো পৃথিবীর অভিকর্ষজ বল কাজ করবে না। শুধুমাত্র যতটুকু আমাদের নিচে আছে তার অভিকর্ষ বল কাজ করবে; বাহিরের খোলসের অভিকর্ষজ বলের প্রভাব একে অপরকে নাকোচ করে দিবে। ফলে সুত্রের ধ্রুব M (পৃথিবীর ভর) অকার্যকর হয়ে পড়বে। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে অভ্যন্তরের জন্য ginside বের করতে বই এর এই সূত্র ব্যবহৃত হবে,

 ginside  =  gr/Rearth  [ r= পৃথিবীর কেন্দ্র হতে দূরুত্ব , g= 9.8 ]

অর্থাৎ পৃথিবীর যতই ভিতরে দিকে যাব g এর মান ততই কমবে এবং কেন্দ্রে (r=0) ginside হবে 0 ( যদিও পুরোপুরি 0 হয় না ,ঘনত্বের তারতম্যের কারণে)। যাই হোক, এবার ginside  ব্যবহার করে আমরা বলের সুত্রটা আবার দেখি; তবে একটু অন্যভাবে,

 F = m.ginside

    ⇒ F = m. g.r/ Rearth

    ⇒ F = kr    ( যেখানে k ধ্রুবক,  k =m.g/ Rearth ;  এখানে ৩ টি রাশিই ধ্রুবক, তাই k ও ধ্রুবক)

এখানে, r হল পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরুত্ব আর আমরা যাচ্ছি ঠিক পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে (উল্টো দিকে)। তাহলে দিক বিবেচনা করে আমরা r কে ঋণাত্মক বলতেই পারি,

F= -kr

এবার কি সমীকরণটাকে চেনা চেনা লাগছে? এটা হুবহু স্প্রিং (সরল ছন্দিত স্পন্দন)  এর সূত্র F= -kx ( হুকের সূত্র) এর মত না 😯 ? তার মানে কি দাড়াচ্ছে? আমাদের আকর্ষণকারী বল ও স্প্রিং এর টানা বল একই!! তবে কি আমাদের গতিও হবে হুবহু একটা স্প্রিং এর মতই? 😯

ঠিক তাই। হুবহু একটা স্প্রিং কিংবা সরল দোলক এর মত সুড়ঙ্গ দিয়ে একবার ওপাশে যাব আবার ফিরে আসব; এবং এভাবেই চলতে থাকবে! তবে আমাদের তো আমেরিকা গিয়ে থামতে হবে, না হলে আর কী লাভ। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই; কারণ আমেরিকা যখন পৌঁছাব তখন আমাদের বেগ থাকবে 0 (স্প্রিং বা সরল দোলকের যেমন প্রান্তবিন্দুতে বেগ 0 হয় তেমনি)  আর তাছাড়া রিসিভ করার জন্য আমাদের চ্যাট বন্ধু তো থাকবেই।

তাহলে সরল ছন্দিত স্পন্দনই আমাদের আমেরিকা পৌঁছে দিবে কোন শক্তি খরচ ছাড়াই। এখন জানা দরকার কত সময় লাগবে? অনেক বেশি? শর্টকাটে বেশি সময় লাগলে সময় লাগলে তো লাভ হবে না।

দেখা যাক, আমরা সময় নির্ণয়ের জন্য সরল ছন্দিত স্পন্দনের দোলনকালের সূত্র ব্যবহার করতে পারি,

T =  2π√(m/k)            এখানে, k=mg/ Rearth

  ⇒  T = 2π( Rearth/ g)     এবার R= 6378000m , g = 9.8  বসিয়ে,

 ⇒   T = 84.5 minitue!!!

পর্যায়কাল 84.5 মিনিট! মানে আমেরিকা যেতে লাগবে মাত্র 43 মিনিট!! 😯 যেখানে আকাশপথে যেতে লাগে ২৪ ঘণ্টা, সেখানে মাত্র…! 🙄

দেখা যাক, যাত্রাপথে আমাদের বেগ কত থাকে। লাফ দেয়ার সময়ে আমাদের বেগ থাকবে 0। বাড়তে বাড়তে আমরা যখন কেন্দ্রের অর্ধেক দূরুত্বে যাব তখন বেগ হবে 24000 কি.মি./ঘন্টা; আর পৃথিবীর কেন্দ্র অতিক্রমের সময়ে বেগ দাঁড়াবে 29000 কি.মি./ঘন্টা!! 😎

তাহলে আর দেরি কেন? লাফ দিলেই তো হয়… দাঁড়ান, আমাদের এখনও সুড়ঙ্গই তো খোঁড়া হল না, লাফ দিবেন কিসে? আসুন দেখা যাক, সুড়ঙ্গ খুঁড়তে আমাদের কি কি দরকার? বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খুঁড়তে কি ধরনের শক্তিশালী মেশিন লাগবে তা অনুমান করার জন্য এই তথ্যই যথেষ্ট যে, পৃথিবীর কেন্দ্রের চাপ আমাদের পৃথিবী পৃষ্ঠের চাপের চেয়ে 3000000 (৩০ লক্ষ) গুন বেশি । যদি ধরেও নেই আমরা সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেললাম ( অ্যান্টি-ম্যাটারের শক্তি কাজে লাগিয়ে 😀 ) , তাও এই বিশাল চাপে সুড়ঙ্গ দুমড়ে মুচড়ে যাবে 🙁 । তাও ধরে নেই আপনি এ সমস্যাও সমাধান করেছেন, সুড়ঙ্গ প্রস্তুত। তাহলে আরো বড় সমস্যা; যদি আপনি 10 মিটার ব্যাসার্ধের একটা সুড়ঙ্গ বানান, তাহলে এর ফলে পৃথিবীর মাঝখানে একটা বিশাল বড় সিলিন্ডার আকৃতির ফাঁপা স্থান তৈরি হবে। তাতে বেশি কিছু হবে না, শুধু পৃথিবীর আহ্নিক বেগ বেড়ে যাবে, আর হবে শক্তিশালী ভুমিকম্প। আপনি লাফ দেয়ার আগেই হয়ত ধ্বংস-স্তূপের নিচে চাপা পড়বেন কিংবা বেশি আহ্নিক বেগের কারণে ছিটকেও যেতে পারেন পৃথিবী থেকে। সেক্ষেত্রে আমেরিকার বদলে চাঁদে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও ফেলে দেয়া যায় না।

তাও যদি আমার কথা পাত্তা না দিয়ে যেতে চান, তাহলে শুনুন, পৃথিবীর ভেতরে কিন্তু প্রচন্ড গরম! যাওয়ার মাঝপথেই গলে যাবেন; এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা 6000 ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভাবছেন ডায়মন্ডের (গলনাঙ্ক স্ফুটনাংক 3730 ও 4827 ডিগ্রি সেলসিয়াস) শিল্ড পড়ে যাবেন? তাতেও লাভ হবে না,  শেষপর্যন্ত আমেরিকা পৌঁছাবে না আপনার শরীর (ঊর্ধ্বপাতিত হয়ে যাবে), আত্মা পৌঁছালেও পৌঁছাতে পারে।

এরপরও যদি নিজেকে সুপারম্যান ভাবেন, তাহলে দেখ ভাই! তুমি হাজার চেষ্টা  করে বাংলাদেশ বরাবর সুড়ঙ্গ কেটে আমেরিকা যাইতে পারলেও USA যেতে পারবা না। কারণ বাংলাদেশের নিচে USA ই নাই :mrgreen: !!

হ্যা, এটা একটা প্রচলিত ভুল ধারণা মাত্র; বাংলাদেশের কোন জায়গা বরাবর নিচে গেলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA) পৌঁছানো সম্ভব নয়। USA এর সবচেয়ে কাছে পৌঁছান যাবে তেঁতুলিয়া বরাবর সুড়ঙ্গ কাটলে; আর আপনি উঠবেন গিয়ে গাল্ফ অফ মেক্সিকোতে (সাগর 😡 ) ; তবে একটু সাঁতরালেই গিয়ে উঠবেন জগতখ্যাত মিয়ামি সি বিচ-এ 😳 । ভাল তো , ভালো না?

তা,আপনি কি ইতোমধ্যে হাল ছেড়ে দিয়েছেন? প্রথমেই বলেছিলাম আমরা কখনই হাল ছাড়ব না। সুড়ঙ্গ পথে পারি নি, ব্যাপার না ; সামনে অন্য কোন ভাবে USA যাওয়ার চেষ্টা করব। এবং অবশ্যই বৈজ্ঞানিক উপায়ে……সাথেই থাকুন

কৃতজ্ঞতা:

  • খালেদ মোশাররফ মুকুট
  • জুল ভার্ন
  • ইয়াকভ পেরেলম্যান
  • বন্ধুবর্গ